আমি মৌমিতা বলছি!
আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
৮ই আগস্ট, ২০২৪ ও ৯ আগস্ট,২০২৪
চোখটা বন্ধ হয়ে আসছে; নিঃশ্বাস চলছে ধীরগতিতে, শরীরে হায়নাদের কামড় আর আঘাতের ক্ষত, মৃত্যু যন্ত্রণায় চোখের কোণ থেকে পানির মতো রক্ত ঝরছে; হয়তো কিছুক্ষণের মাঝে আমার আত্মা এই দেহের মায়া ত্যাগ করবে। কতশত স্বপ্ন এঁকেছিলাম, একটা সুন্দর সংসার, সহজ-সরল জীবন আরও কত কি! মুহূর্তের মাঝেই আমার সব স্বপ্ন শেষ করে দিলো একদল নরপিশাচেরা।
আমি মৌমিতা; ডাঃ মৌমিতা দেবনাথ, স্নাতকোত্তর দ্বিতীয় বর্ষের চেস্ট ডিপার্টমেন্টের শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে আছি পশ্চিমবঙ্গের আর. জি. কর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। মা-বাবার অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে চিকিৎসা সেবায় এসেছিলাম মানুষের পাশে দাড়ানোর জন্য; যখন মেডিকেল কলেজে পড়তাম, খুব করে চাইতাম যেনো একজন বিশ্ব মানের চিকিৎসক হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারি। জনমানুষের কল্যাণে নিজেকে যাতে সব সময় নিয়োজিত করতে পারি। আজ বয়স ত্রিশের কোটা পেড়িয়েছে। একজন চিকিৎসক হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ও একটু একটু করে স্বপ্নের পথে হাটছি। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে জন্মানো; এরপর আবার ডাক্তারি পড়া, সবটাই আমার পরিবারের ত্যাগ এবং কষ্টের ফসল। শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসেবে আমার ডিউটি টাইমটা একটু বেশিই চাপের। এইতো গত সপ্তাহেও টানা নাইট শিফট ছিলো; আর নাইট শিফট মানেই তো আর ঘুম নয়, কিছুক্ষণ পরপর নতুন রোগী আসছে, এছাড়া পুরনো রোগীদের জরুরী প্রয়োজন তো থাকেই। এরপর আবার দেখুন ডিউটি পরিবর্তনের সময় আবার টানা দুই-তিন শিফটের ডিউটি করতে হয়।
নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আমি, এখন নিজে স্বল্প হলেও কিছু রোজগার করছি। অনেক অপূর্ণ শখ নিজেই পূরণ করতে পারছি, তাই মাঝে মাঝে খুব ভালোই লাগে; যত চাপই থাকুক না কেনো! কিছু রোজগার তো করছি। অনুজদের সাথে সময় কাটাতে আমার বেশ ভালোই লাগে; নিজেকে আবার সেই স্নাতক পড়ুয়া মনে হয়, মনে পড়ে যায় সেই মেডিকেল কলেজ জীবনের হাসি খুশি জীবন আর অ্যানাটমি বই নিয়ে দৌড়াদৌড়ির স্মৃতি।
আজ ৮ই আগস্ট, টানা ৩০ঘন্টার উপরে ‘অন-কল’ ডিউটি চলছে আমার। কিছুক্ষণ আগে একটা জটিল কেস এসেছিলো।সিভিআর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট মানে আমরা যেটাকে হার্ট অ্যাটাক বলি; লোকটার ব্লক আছে এবং তাও অনেক গুরুতর। সৃষ্টিকর্তার কৃপায় লোকটা বেঁচে গেলেন। লোকটার আত্মীয়রা আমাকে দেবতুল্য সম্মান দিতে শুরু করলেন; কেউ কেউ তো বলতে লাগলেন সাক্ষাৎ দেবী রূপে আমার আবির্ভাব হয়েছে। চিকিৎসক হিসেবে যেই আনন্দটা আমি অনুভব করি তা আসলে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে ব্যার্থ। চিকিৎসা পেশা এসে আসলে নিজেকে দেব-দেবীর দূত হিসেবেই অনুভব করছি।
মাত্রই অলিম্পিকে জ্যাভলিন থ্রোর ফাইনালে ভারতের নীরজ চোপড়ার ইভেন্ট শুরু হয়েছে, সময় রাত ১১টা বেজে ৫৫ মিনিট। রৌপ্য পদক এনেছে নীরাজ আমাদের দেশের জন্য; আমি মনে করি খেলাধুলা আমাদের দেশকে বিশ্বের কাছে আলাদাভাবে পরিচিত করে।তাই খেলাধুলায় বিশেষ করে ক্রিকেট বিশ্বকাপ আর অলিম্পিকের প্রতি আমার একটু আলাদা ঝোঁক কাজ করে।
ঘড়ির কাঁটা ১২ টা পেড়িয়ে গেলো, তারিখটাও পালটে গেলো। ইতোমধ্যে ৯ই আগস্টের দিন গণনা শুরু হয়ে গিয়েছে। খেলা দেখতে দেখতে অনলাইনে কিছু খাবার অর্ডার করেছিলাম; ভাবলাম অনুজদের সঙ্গে রাতের খাবারটা ভাগাভাগি করে নেই। আসলে আমি মনে করি পছন্দের খাবার ভাগ করে খেলে আত্মার সাথে আত্মার আত্মীয়তা ঘটে।
এভাবেই রাত ২টা পেড়িয়ে গেলো; আমারও ডিউটি শেষ হলো। টানা ৩৬ ঘন্টা ‘অন-কল’ ডিউটি! বাবাহ! নিজেকে খুবই যান্ত্রিক লাগছিলো। ভাবছি এবার কিছু সময়ের জন্য বিশ্রাম নিয়ে নেই। তাই একাই চলে এলাম চারতলায় পালমোনোলজি বিভাগের সেমিনার হলে। পুরো একটা সেমিনার হল আর আমি একা। সেই সাথে, এতটা ক্লান্ত লাগছে – মনে হচ্ছে শরীর গ্লুকোজ শূন্য হয়ে আছে। তারপরেও ভাবলাম একটা বই হাতে নেই, চোখ বুলিয়ে দেখি। কিন্তু বইয়ের পাতায় তো আফিমের থেকেও তীব্র নেশার জন্ম দেয়। আমি ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ি সেমিনার হলের চেয়ারের উপরেই। কিছুক্ষণের মাঝেই আমি মানুষ রূপী কয়েকটা হায়নার উপস্থিতি অনুভব করলাম। হঠাৎ ঘুম ভাঙায় স্তব্ধ আমি ঠিক অনুমান করতে পারছিলাম না কি হতে যাচ্ছে আমার সাথে; তবে হঠাৎ তাদের উপস্থিতি আমাকে অনেক ভীত করে তোলে। কিন্তু আবার নিজের সাহস জোগান দিতে দিতে ভাবছি না… “যাহ! ভয়ের কিছুই নেই। ওরা তো আমার কলেজেরই। নাহ! কিছু হবে না”
তবে মুহুর্তের মাঝেই আমার এই ধারণা পালটে গেলো। ওদের মধ্যে দু’জন দু’দিক থেকে আমাকে শক্ত করে চেপে ধরে; চেহারাগুলো খুব পরিচিত আমার। যৌনতার লালসায় হিংস্র হয়ে স্পর্শ করতে থাকে আমার শরীরটা। দীর্ঘদিনের ক্ষুধার্ত কুকুরের মতো ছিলো ওদের তীব্রতা; ঠিক যেমন ৪-৫টা ক্ষুধার্ত কুকুরের সামনে একটুকরো রুটি দিলে হয়। ওরা আমার শরীরটাকে ছিঁড়ে খাওয়ায় কোনো চেষ্টার কমতি রাখেনি। এতটা শক্ত হাতে আমার গলা চেপে ধরেছিলো যে, সামান্য বাঁচানোর আকুতিটুকু আমি করতে পারছিলাম না,চিৎকার করে নিজেকে বাঁচানো জন্য সাহায্য চাওয়ার ক্ষমতাটাও কেড়ে নিয়েছে ওরা, যখন কাঁদছিলাম তখন আমার চোখের পানির বদলে মনি থেকে রক্ত ঝরছিল। আমি এতটা অনুনয়-বিনয় করলাম, কতোবার হাতে-পায়ে পরলাম কিন্তু ওরা একটাবারের জন্যও আমার কথা শুনলেন না। আমি অগণিতবার বলেছিলাম আমাকে এবারের মতো মাফ করে দিন, আমি কাউকে কিছু বলব না, প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে, আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু তারপরেও ওরা একের পর একজন বারবার ওদের হিংস্রতার বহিঃপ্রকাশ করতে লাগলো আমার ওপর। জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে ওদের রুখতে না পেরে, আমি ভাবছিলাম এই জন্মে হয়তো মেয়ে হয়ে জন্মটাই আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুক্ষণ আগেই আমি কারো কারো কাছে দেবী রূপে আবির্ভূত হয়েছিলাম। তাহলে এই নরপিশাচদের চেতনায় কী দেবীদেরও এই নির্মম পরিনতি???
আমার মাঝে কেনো ওরা একটা বারের জন্যও ওদের নিজের মা-বোনকে ভাবতে পারলো না???
আচ্ছা… আমার ভুল কি ছিলো???
“বিকৃত যৌনতা থেকে যদি পুরুষত্বের পরিচয় দেয়া যায়, তবে ঘৃণা করি এই পুরুষ জাতিকে।
ঘৃণা করি আমি সেই সকল পিতাকে; যে ধর্ষণের পরে সেই হাতে তার সন্তানকে স্নেহ করে।
ঘৃণা করি সেই সকল ভাইদের; যারা ধর্ষণের পরে তার বোনের হাতে ভাই ফোঁটা পরে।
ঘৃণা করি সেই সকল সন্তানকে; যারা ধর্ষণের পরে তার মা-বাবার সম্মুখে সেই চেহারা নিয়ে দাঁড়ায়।”
আমার নিঃশ্বাস আর চলছে না। আমার অর্ধনগ্ন দেহ আবৃত করার সামর্থ্যটুকুও আমার আর নেই। সেমিনার হলের মেঝেতেই আমার শরীর সাক্ষ্য দিবে এই নরপিশাচদের নারকীয়তার। ময়নাতদন্তের জন্য যখন এই দেহ ছিড়েখুঁড়ে দেখা হবে,আমার দেহের প্রতিটি ক্ষত সাক্ষ্য দিবে এই বলে যে,
– আমার ময়নাতদন্তের সময়ে যে কষ্ট হচ্ছে এর থেকে তীব্রতর যন্ত্রণায় আমাকে হত্যা করা হয়েছে।
আচ্ছা.. তোমরা কি আমার জন্য লড়বে? এক হয়ে একটু বলবে? আমার তো জীবনটাও কেড়ে নিলো এবার অন্তত ন্যায় বিচারটুকু দাও। আমি বিচার চাই।
আমি মৌমিতা বলছি!!!
লেখাঃ সিফাত আল সাদ (স্মরণ)
শিক্ষার্থী, স্নাতকোত্তর(শান্তি, সংঘর্ষ ও মানবাধিকার অধ্যয়ন/Peace, Conflict and Human Rights Studies),
বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি), মিরপুর সেনানিবাস, ঢাকা।