রবিবার, জুলাই ৬

ঐতিহাসিক বরিশাল খাল খনন: মাদারীপুর শহরের হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের প্রয়াস

একদা যা ছিল মাদারীপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র ও অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি, সেই ঐতিহাসিক বরিশাল খাল সময়ের স্রোতে দখল, দূষণ আর অবহেলায় পরিণত হয়েছিল শহরের এক দুঃখজনক অধ্যায়ে। যে খালের বুক চিরে একসময় বরিশাল পর্যন্ত চলত ছোট-বড় নৌযান, গড়ে উঠেছিল বাণিজ্য, তা কালের বিবর্তনে হয়ে ওঠে আবর্জনার ভাগাড় আর জলাবদ্ধতার কারণ। তবে দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর সেই অচলায়তন ভাঙতে শুরু করেছে। মাদারীপুর পৌরসভার উদ্যোগে শুরু হওয়া খননকাজ শহরবাসীর মনে জাগিয়েছে নতুন করে স্বপ্ন দেখার আশা—হারানো শ্বাসপ্রশ্বাস ফিরে পাওয়ার আশা।

৮ কিলোমিটার দীর্ঘ বরিশাল খালটি কেবল একটি জলপথ ছিল না; এটি ছিল মাদারীপুরের জীবন ও সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই খালকে কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্য বিকশিত হয়েছিল, যা শহরের অর্থনীতিকে সচল রাখত। কিন্তু ধীরে ধীরে খালের দুই পাড় অবৈধ দখলে চলে যায়, অপরিকল্পিতভাবে আবর্জনা ফেলায় এর পানিপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায় এবং পলি জমে ভরাট হতে থাকে এর তলদেশ। ফলস্বরূপ, বর্ষা মৌসুমে সামান্য বৃষ্টিতেই শহরে সৃষ্টি হতো ভয়াবহ জলাবদ্ধতা, যা জনজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। খালের স্বচ্ছ পানির স্রোত হারিয়ে গিয়েছিল কচুরিপানা ও দুর্গন্ধময় আবর্জনার নিচে।
খনন কাজে আশার আলো:
সম্প্রতি মাদারীপুর পৌরসভা এই মৃতপ্রায় খালকে পুনরুজ্জীবিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ইটেরপুল থেকে কুমার নদ পর্যন্ত অংশে খননকাজ শুরু হয়েছে। সরেজমিনে দেখা যায়, এক্সকাভেটর দিয়ে খালের গভীর থেকে তোলা হচ্ছে বছরের পর বছর জমে থাকা পলি ও আবর্জনা। এই দৃশ্য দেখে স্থানীয় বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে।
ইটেরপুল এলাকার বাসিন্দা দুলাল মণ্ডলের কথায় ফুটে ওঠে সাধারণ মানুষের উচ্ছ্বাস। তিনি বলেন, “খালটি মরে যাওয়ায় বর্ষার পানি নামার কোনো পথ ছিল না, আমাদের ঘরবাড়ি ডুবে যেত। এখন খনন শুরু হওয়ায় আমরা জলাবদ্ধতার অভিশাপ থেকে মুক্তির আশা করছি।”
একইভাবে, স্থানীয় ব্যবসায়ী রফিক মিয়া জানান, “এই খালটি শহরের লজ্জা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দুর্গন্ধে এর পাশ দিয়ে হাঁটা যেত না। যদি খালটি আগের মতো নাব্য ফিরে পায়, তবে আমাদের ব্যবসাও প্রাণ ফিরে পাবে এবং শহরের পরিবেশও সুন্দর হবে।”

মাদারীপুর পৌরসভার প্রশাসক মোহাম্মদ হাবিবুল আলম জানিয়েছেন, শুধু খননকাজই নয়, খালটিকে স্থায়ীভাবে রক্ষা করার জন্য একটি সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক খননকাজের জন্য ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। পাশাপাশি, খালের দুই পাড়ের সমস্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ এবং খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলা বন্ধে কঠোর আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তিনি বলেন, “আমাদের মূল লক্ষ্য কেবল খাল খনন নয়, বরং বরিশাল খালের ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক গুরুত্ব সম্পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার করা। আমরা চাই, এই খালটি আবার শহরের গর্বের প্রতীকে পরিণত হোক।”

বরিশাল খালের এই পুনরুদ্ধার কেবল একটি জলাশয় খনন নয়, এটি মাদারীপুর শহরের হারানো আত্মপরিচয় ও প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনার এক মহৎ প্রচেষ্টা। এই উদ্যোগ সফল হলে শুধু শহরের জলাবদ্ধতাই দূর হবে না, ফিরে আসবে একটি সুস্থ পরিবেশ এবং নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ার স্বপ্ন। এই খননকাজ তাই মাদারীপুরবাসীর জন্য শুধুই একটি প্রকল্প নয়, এটি এক নতুন দিনের সূচনার প্রতীক, যা একটি শহরের ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা বহন করে।

দেশকাল টিভি -চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন,ধন্যবাদ।

জনপ্রিয় পোস্ট

এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পূর্ণ বেআইনি। সকল স্বত্ব www.deshkaltv.com কর্তৃক সংরক্ষিত